Tuesday, November 5, 2013

খালাসে উল্লাস, সাজায় ক্ষোভ-কান্না

বাংলাকাগজ রিপোর্টঃ পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহের রায়ের পর একদিকে যেমন দেখা গেছে কারো কারো খালাসের আনন্দ, অন্যদিকে দণ্ডিত হয়ে ক্ষোভের প্রকাশ। চার বছর আগে সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয় মঙ্গলবার।
সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একে একে আনা হয় ৮১৩ জন আসামিকে। বিশাল এই বিচারকাজের এজলাস কক্ষও ছিল কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সাধারণ অন্য বিচারে আসামিদের জন্য ছোট একটি কাঠগড়া থাকলেও এই এজলাস কক্ষের বড় অংশজুড়েই ছিল আসামিদের বসার জায়গা।
ওই কাঠগড়া আবার তিনভাগে বিভক্ত। পেছনের দিকে বড় অংশে আসামিদের এনে রাখা হয়। রায় ঘোষণা সময় বিচারক আসামিদের ‘সিএস (চার্জশিট) ক্রম’ উল্লেখ করছিলেন।
ক্রম অনুযায়ী আসামিরা এসে সামনের মধ্যবর্তী আরেকটি কক্ষে এসে বসতে থাকেন। বিচারক দণ্ড ঘোষণার পর সেখান থেকেই আসামিদের নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। এভাবেই সব দণ্ডের আসামিদের ক্রম ঘোষণা, আসন গ্রহণ, দণ্ড ঘোষণা এবং কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেকটি কক্ষ ফাঁকা ছিলো।
সোয়া ১০ টার পর আসামি আনা শেষ হয়। ১২টার পর বিচারক আদালতে আসেন। ১২টা ৩৩ মিনিটে এজলাসে এসে রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারক। প্রথমে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিতদের সাজা ঘোষণা করা হয়। এরপর ঘোষণা করা হয় খালাসপ্রাপ্তদের দণ্ড।
এ মামলার ৮৪৬ জন জীবিত আসামির মধ্যে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। বাকি ২৫৬ জনকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ।
খালাস ঘোষণার পর আসামিরা বিভিন্নভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। এ সময় অনেকেই ‘মারহাবা মারহাবা’ বলে কোলাকুলি করতে থাকেন পরস্পরের সঙ্গে। আঙ্গুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে তারা বিজয় প্রকাশ করেন। ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরা আসামিদের কোলাকুলির সময় ‘ঝনঝন’ শব্দ হচ্ছিল। এ সময় প্রায় ১২ মিনিট বিচারক রায় ঘোষণা বন্ধ রাখেন।
এরপরই আসামিদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাওয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের প্রিজনভ্যান থেকে চিৎকার করে নাম জানিয়ে প্রতিক্রিয়া দেন খালাসপ্রাপ্তদের অনেকে।
রংপুরের বাসিন্দা সিপাহি জুবায়ের হোসেন ভ্যান থেকে চিৎকার করে বলেন, “সত্যের জয় হয়েছে, আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। আদালত বলেছে আমরা নির্দোষ।”
দোয়া চাইলেন বরিশালের বাসিন্দা নুরুল আমিন। “আপনারা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
একই গাড়ি থেকে নায়েক সুবেদার ইদ্রিস আলী চিৎকার করে তার খালাসের কথা গণমাধ্যমকে জানান। ঢাকা মেট্রো-ম ০৫-০১৫৩ নম্বর প্রিজনভ্যানেই ছিল অন্তত জনাপঞ্চাশেক খালাসপ্রাপ্ত আসামি। 
পেছনের ভ্যানে হাবিলদার ওমর আলী ও সিপাহী তারিকুল টাঙ্গাইলে ভুয়াপুর এলাকার বাসিন্দা উল্লেখ করে তাদের খালাস পাওয়ার কথা জানান।
আসামিদেরকে নিয়ে যাওয়ার পর বিচারক আবার রায় ঘোষণা শুরু করেন। ক্রম উল্লেখ করার পর এবার সংশ্লিষ্ট আসামিরা মধ্যবর্তী একটি কক্ষে আসেন। এরপর তাদের যাবজ্জীবন দণ্ড ঘোষণা করেন।
এরপর নাসির উদ্দিন পিন্টু ও তোরাব আলী যাবজ্জীবন ও জরিমানার দণ্ড আলাদাভাবে ঘোষণা করা হয়।
রায়ের পর নিরব থাকেন তোরাব আলী। তবে পিন্টু বলেন, “সেই দিন স্কুল বন্ধ ছিল। সাক্ষী ছাড়া আমাকে দণ্ড দেয়া হয়েছে। নির্দোষ একটি মানুষকে এই দণ্ড দেয়া হল।”
পরে প্রিজনভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় পিন্টু গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরা লক্ষ্য করে হাত নাড়েন। ১০-১৫ গজ দূরে পুলিশি ব্যারিকেডের বাইরে থাকা কোনো কোনো গণমাধ্যমকর্মী তাকে কিছু বলতে চিত্কার করে অনুরোধ করে। জবাবে হাত ইশারায় ‘না’ করে দেন তিনি। 
পরে আদালত আবার আসামিদের সিএস নম্বর উল্লেখ করতে থাকেন। যাবজ্জীবন দণ্ডের পরের দণ্ড হিসাবে ওই সিএস নম্বরধারীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে বলে তখনই অনুমান করা যাচ্ছিল। তবে নম্বর উল্লেখের সময় এক আসামি চিত্কার করে কেঁদে উঠেন।
তিনি বলেন, “আমাকে ১ মিনিট সময় দেন। আমাকে এই সময়টা দিতেই হবে। এরপর আমাকে যা দণ্ড দিবেন আমি মেনে নেব।”
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বারবার একই কথা বলতে থাকেন। তার চিত্কারের এক পর্যায়ে বিচারক তাকে থামানোর জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন। 
এ সময় পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে গেলে রেজাউল আদালত কক্ষে থাকা বিজিবি মহাপরিচালককে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ডিজি স্যার, ডিজি স্যার, আমাকে বাঁচান। আমি সেই রেজাউল না। সেই রেজাউল পলাতক। আমি নির্দোষ। আমাকে বাঁচান।”
এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা তাকে থামালেও উচ্চস্বরে কাঁদছিলেন। পরে বিচারক নম্বর ঘোষণা শেষ করে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর আসমিদের অনেকেই রেজাউলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে- “এই বিচারই শেষ বিচার না। একদিন আল্লাহর কাছে এটার আবার বিচার হবে। সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় সেইদিন আপনার বিচার হবে।”
প্রিজনভ্যানে তোলার সময় আসামিদের অনেকে সেখানে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে গালাগালি করেন। তাদের বলতে শোনা যায়, “ওই ছবি তুলিস কেন? তোদের সাক্ষীর কারণেই আমাদের দণ্ড হয়েছে।”
এই মামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও সাক্ষ্য দিয়েছেন। 
  • Blogger Comment
  • Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment

Copyright © 2012 দ্বিতীয় আলো All Right Reserved
Designed by CBTblogger